সাহিবজাদা মোহাম্মদ শহীদ খান আফ্রিদি; শুধু শহীদ আফ্রিদিতেই পরিচয়। পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক, সংক্ষিপ্ত সংস্করণে সেরা অলরাউন্ডারদেরও একজন। কিন্তু এ স্রেফ পরিচয়, আফ্রিদি মানে সুদর্শন এক তরুণ, গ্যালারিতে যাঁর জন্য ‘ম্যারি মি…’ প্ল্যাকার্ড আর মাঠে তাঁর চার-ছক্কার চাষাবাদ। বল পেটানোর মতাদর্শে খুব কড়া বিশ্বাস বলেই যেকোনো জায়গা থেকে ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারতেন, হয়ে উঠেছিলেন ‘গেম চেঞ্জার’। ২০১৯ সালে প্রকাশিত আফ্রিদির আত্মজীবনীর নামও সেটাই—গেম চেঞ্জার।
বইটি আসলে আফ্রিদির অভিজ্ঞতা-ভ্রমণ। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিতটি সবারই জানা। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি আসার ৯ বছর আগে ওয়ানডেতে প্রথম ব্যাটিংয়ে নেমেই ৩৭ বলে সেঞ্চুরির বিশ্ব রেকর্ড। ১৯৯৬ সালে নাইরোবির সেই ইনিংসের গল্পটা আফ্রিদি লিখেছেন তাঁর বইয়ে ‘দ্য ইনসমনিয়াকস ড্রিম ডেব্যু’ অধ্যায়ে। চলুন পড়ি সেই গল্পটা।
কী লিখেছেন আফ্রিদি
প্রাথমিক উত্তেজনা কাটল একসময়। আমার প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর তখন ভীতি ও আত্মদর্শনের। তখন বয়সই বা কত! ঠিক যেটার স্বপ্ন দেখেছি, সেটাই পেয়েছি। তবে দুশ্চিন্তা যে ছিল না, তা–ও নয়।
বাবার আর্থিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা হতো। আমি সফল হতে না পারলে পরিবারের যে কী হবে! ড্রেসিংরুমে প্রতিবারই বের হওয়ার সময় মনের মধ্যে একটা ছবি উঁকি দিত। দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার ক্যানভাসে আঁকা একটি পরিবার।
আমরা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের খেলোয়াড়েরা করাচি থেকে বিমানে উঠেছি। অনেকেরই সেটা প্রথম বিমান ভ্রমণ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওড়ার পর ক্যারিবিয়ানে নেমে আমরা বাধাবিপত্তি, বিতর্কের সন্মুখীন হয়েছি, বিহিতও করেছি সবাই মিলে। একে অপরের সঙ্গে এই সম্পর্কটুকু থেকেই আমরা সারা জীবনের বন্ধুত্বের দেখা পাই এবং সেটা শুধু পাকিস্তান দলে নয়, প্রতিপক্ষ দলেও—সারওয়ান, হাইন্ডস, গেইল, কিং। এক দল তরুণের জন্য মনে রাখার মতো প্রথম সফর।কিন্তু হারুন রশিদের সেই ‘টুথব্রাশ কলে’র (কোচ তাঁকে জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার খবর দিয়েছেন ব্রাশ করার সময়) পর আমার দুনিয়াটাই পাল্টে গেল। জিসান পেরভেইজকে নিয়ে বিতর্কে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছিল। প্রমাণের অভাবে মামলা খারিজ। কথা–কাটাকাটির পরও আফ্রিদি তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছিলেন) সতীর্থদের কেউ কেউ আমাকে সন্দেহ করায় খারাপ লেগেছে। ওরা ভেবেছিল, আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেদিনের সেই (জাতীয় দলে) ডাকের পর সেসব কিছুই এখন ঝাপসা স্মৃতি।
কঠিন ভ্রমণসূচিটি মনে আছে। বার্বাডোজ থেকে গায়ানা, গায়ানা থেকে লন্ডন, লন্ডন থেকে দুবাই, দুবাই থেকে করাচি—সেখানে এক ঘণ্টা দাঁড়াতে পারব, পরিবারের সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য দেখা হবে। আমার খেলার সরঞ্জামগুলো নিতে হবে তাঁদের কাছ থেকে। এরপর করাচি থেকে দুবাই ফিরে সেখান থেকে নাইরোবি। সবকিছু সেরে নাইরোবির বিমানে ওঠার পর এতটাই ক্লান্ত ছিলাম যে ঘুম আর হয়নি। এক মিনিটও না।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমার এমন কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হবে, যাঁদের পাকিস্তানের প্রতিটি শিশু-কিশোর চেনে এবং তাঁদের মতো হতে চায়। দেখা হলে কেমন লাগবে? ড্রেসিংরুমটা কেমন হবে? যেমন শুনেছি ওয়াসিম আকরাম কি ততটাই লম্বা? ওয়াকার ইউনিসের কবজি কতটা শক্ত? হাত মেলানোর সময় নিশ্চয়ই টের পাব! ইনজি কতটা বিশাল? এসব নাম আমার কাছে স্বপ্নের মতো, তাঁরা কি আমাকে ভালোভাবে নেবে? নাকি এতটুকুও ছাড় দেবে না? আচ্ছা, আমার মতো অল্প বয়সীকে মেনে নেবে তো? দলে নেবে? নাহ, আর ভাবতে পারছি না। নাইরোবির পথে ক্লান্তি ভর করলেও রোমাঞ্চে জোয়ার কমেনি।
প্রথম যে পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের সঙ্গে হোটেলের লবিতে দেখা হলো, আমির সোহেল, আগ্রাসী বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। সোহেলই সবার আগে আমাকে কাছে টেনে নেন। (এটা দুঃখের যে পরবর্তী সময়ে প্রথম যে পাকিস্তানি খেলোয়াড়ের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদের শুরু হলো, সেটাও তিনি-ই।)
লিফটের কাছে হঠাৎ সাকলায়েন মুশতাকের সঙ্গে দেখা। সে-ও বেশ তরুণ। সেদিন জানতাম না, বছরের পর বছর পেরিয়ে আমরা দারুণ বন্ধু হব, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীও। একটু পরই ওয়াসিম (আকরাম) ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। আমার আজও তাঁকে দেখে মনে হয়, কী একটা মানুষ! কী দারুণ নেতা! কী সুবিশাল ও দয়ালু ব্যক্তিত্ব! দলের সঙ্গে প্রথম দিন ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি, আমার ক্যারিয়ারে তাঁর ভূমিকা কত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, মাঠ ও মাঠের বাইরে কীভাবে তিনি আমার সবচেয়ে বড় মেন্টর হয়ে উঠবেন।
সবাই আমাকে খুব ভালোভাবে গ্রহণ করলেন। বিশেষ করে মঈন (খান) ভাই। তিনি হয়ে উঠলেন আমার জন্য ন্যায় ও দলীয় বন্ধনের মাপকাঠি। দলে আমার প্রথম অকৃত্রিম বন্ধু। অবশ্যই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশটা হয় সময়ের সঙ্গে। তবে প্রথম দিনে আমার ওপর ‘তারকাপাত’ হয়েছিল। আমার আশপাশে সবাই তারকা। আসলে দলের সবাই। সাঈদ আনোয়ার (অধিনায়ক), সেলিম এলাহী, ইজাজ আহমেদ, রমিজ রাজা, সেলিম মালিক, মঈন খান, সাকলায়েন মুশতাক, ওয়াকার ইউনিস, শহীদ নাজির এবং বাকিরা—সুপারস্টার। ২০১৯ সালে বর্তমান পাকিস্তান দলে এমন এক বা দুজন। ১৯৯৬ সালের সেই পাকিস্তান দলে সবাই তারকা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন